আয়ুর্বেদিক ধারনায় হিজামা / রক্তমোক্ষণ
ক্যাটাগরি: শারীরিক স্বাস্থ্য, সাধারন স্বাস্থ্য | তারিখ: 03/01/19 | No Comment
( আয়ুর্বেদিক ছাত্রদের জন্য এই লেখাটি উপকারে আসবে , তাঁদের (DAMS) ৪র্থ বর্ষের সার্জারিতে এই জিনিষ প্রাক্টিক্যাল আছে । ছাত্ররা এই লেখা কপি কইরা রাখো আখেরে কামে দিবে )
.
রক্তমোক্ষণের ৩ টি পদ্ধতি জনপ্রিয় ১) জলৌকাচারণ (Leeching) , ২) শিরাভেদ (Venesection) ৩) শিঙ্গা (হিজামা / Blood-cupping) .
পদ্ধতি তিনটা কিন্তু কাজ কাম একটাই , তা হলো দেহ থেকে রক্ত বের করে চিকিৎসা করা।
.
আসেন আগে রক্তমোক্ষণ নিয়ে কিছু বলি , একদম রসকষহীন শাস্ত্রীয় কথা বার্তা পড়ার জন্য রেডি হয়ে যান-
রোগীর বল এবং রক্তের পরিমান বুঝে রক্তমোক্ষণ করতে হয়। অর্থাৎ রোগীর বল ও রক্তের পরিমাণ যদি নিতান্ত অল্প হয়, তা হলে দূষিত রক্তও অধিক পরিমানে মোক্ষণ করা উচিৎ না। অথবা যে পর্যন্ত না বিশুদ্ধ রক্ত নির্গত হয়, সে পর্যন্ত দূষিত রক্ত মোক্ষণ করতে হয়। অর্থাৎ বিশুদ্ধ রক্ত দেখা মাত্রই স্রাব বন্ধ করতে হয়। রক্তজ ব্যাধির আশ্রয়স্থান লক্ষ্য করে রক্তমোক্ষণ করতে হয়। অর্থাৎ আশ্রয় স্থানের রক্তবর্ণাদি বিনষ্ট হয়েছে দেখলেই রক্তমোক্ষণ বন্ধ করতে হয় ।
.
আমরা উপরের লেখায় বিশুদ্ধ রক্তের কথা বলেছি , এবার জানবো আয়ুর্বেদিক কনসেপ্টে বিশুদ্ধ রক্তের লক্ষন , যে রক্ত তপ্তকাঞ্চননিভ বা ইন্দ্রগোপকিট প্রভ অথবা যা পদ্মরাগ মনি, আলতা ও গুঞ্জাসম বর্ন বিশিষ্ট তাই বিশুদ্ধ রক্ত । কি বুঝলেন ? জানি বোজেন নি , আপাদত এই জিনিশ না বুজ্জাই সামনে যাই , চলেন ।
এবার জানবো , দোষভেদিক দূষিত রক্তের লক্ষনঃ
বাত কুপিত বা দূষিত রক্তের লক্ষন- অরুণ বর্ন , ফেনিল, অপিচ্ছিল এবং পাতলা হয়।
পিত্ত কুপিত বা দূষিত রক্তের লক্ষন – পীত বা কৃষ্ণবর্ন এবং পিত্তের উষ্ণতার জন্য দেরিতে গাঢ় ( কোয়াগুলেশন) হয়ে থাকে ।
এই দুই দোষ মিলিত রক্তে উভয় লক্ষনের মিশ্রিত রূপ দেখা যায় । এবার রইলো কফ কুপিত বা দূষিত রক্তের লক্ষন , ওয়েট এইডা পরে বলুম ।
.
জলৌকা ( জোঁক ) এবং শস্ত্র ( আমরা ১১ নাম্বার সার্জিক্যাল ব্লেড ব্যবহার করি) দ্বারা রক্তমোক্ষণ করা হয়ে থাকে । জোঁক ! নাম শুনলেই কেমন গা গোলানো একটা ভাব হয় ! ইয়াক থু টাইপের অনুভূতি কাজ করে । এই জোঁক দিয়ে চিকিৎসা করা হয় , চিকিৎসা পদ্ধতির আয়ুর্বেদিক নাম হলো জলৌকাচারণ ! ইংলিশে বলে Leeching থেরাপি । এটা হচ্ছে রক্তমোক্ষণের একটা পপুলার পদ্ধতি ।কিছু ক্ষেত্রে জলৌকাচারণ (Leeching) ছাড়া অন্য পদ্ধতি ব্যবহার করা যায় না । যেমন গ্যাংরিন বা এমন কোন দূষিতক্ষত চিকিৎসায় ।
শস্ত্রবিস্রাবন বা শস্ত্র দ্বারা রক্তমোক্ষণ দুই প্রকার । যথাঃ ১) প্রচ্ছান ২) শিরাভেদ (Venesection) ।
ঋজু ( প্রাঞ্জল) , অসংকীর্ণ, সূক্ষ্ম , সম( তুল্যরেখ ) , অনবগাঢ়, অনুত্তান এবং অবিলম্বিত ভাবে শস্ত্রপাত করতে হয় যেনো মর্ম, শিরা, স্নায়ু ও সন্ধি আহত না হয়।
জলৌকা (জোঁক) দ্বারা রক্ত মোক্ষণ করতে হলে, উপযুক্ত স্থানে জলৌকা বসাইয়া তার গায়ের উপর উপর আদ্রবস্ত্র বসাইয়া দিতে হয় ( আমি ভেজা তুলা বসাইয়া দেই ) । তবে লক্ষ্য রাখতে হয় যেনো জোকের মুখ না ঢাকা পরে। দংশন স্থানে যখন তোদ ও কন্ডুয়ন ( চুলকানি) হয় তখন বুজতে হয় জোঁক বিশুদ্ধ রক্ত পান করতেছে । এই সময় একে ছাড়াইয়া নিতে হয় । যদি সহজে না ছাড়ে, তাহলে জোকের মুখে সৈন্ধব লবন চুর্ন দিলে মুখ ছেড়ে দেয়।
বাত দুষ্ট রক্ত মোক্ষণে শৃঙ্গ অর্থাৎ গোশৃঙ্গ বা গরুর শিং , পিত্ত দুষ্ট রক্ত মোক্ষণে জলৌকা ( জোঁক) এবং কফ দুষ্ট রক্ত মোক্ষণে অলাবূই প্রশস্ত ।
তবে যখন কোন যন্ত্র , বা জোঁক পাওয়া যাবে না তখন সকল অবস্থায় শিঙ্গা দ্বারা সকল প্রকার ( বায়ু পিত্ত কফ ) দূষিত রক্ত মোক্ষণ করা যায় ।
এই শিঙ্গাকে আরবিতে হিজামা বলে ।
.
রক্ত মোক্ষণের পরবর্তি করনীয়ঃ রক্তমোক্ষণের পরে নাতিশীতোষ্ণ , লঘুপাক ও অগ্নিউদ্দীপক খাদ্য উপকারী ।
বিশুদ্ধ রক্তবান লোকের লক্ষনঃ যার বর্ণ ও ইন্দ্রিয় গনের প্রসন্নতা থাকে, ইন্দ্রিয় বিষয় ভোগের স্পৃহা থাকে, অবাধে খাবার হজম হয়, যথাসময় ও যথানিয়মে মলমূত্রের বেগ উপস্থিত হয়ে মল মূত্র নিঃসারিত হয়। এই সুখাণ্বিত ও বলপুষ্টিশালী ব্যক্তির রক্ত বিশুদ্ধ ।
.
এতক্ষন যে বায়ু পিত্ত কফ নিয়ে বললাম আসলে এইটা কি –
আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, মানবদেহ তিনটি মূল বা সার বস্তুর সমন্নয়ে গঠিত। এই সার বস্তু তিনটি হলো বায়ু(Vata) , পিত্ত ( Pitta) এবং কফ (Kapha) । “বাতা/বায়ু” আমাদের মন ও স্নায়ু তন্ত্রের সাথে জড়িত। এর সভাব বা পকৃতি হচ্ছে শুষ্ক, ঠান্ডা, হালকা এবং শক্তিশালী । ২য় সার বস্তু হলো “ পিত্ত/ অগ্নি” যা আমাদের বিপাক( হজম) ক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত , যা আমাদের দেহের যাবতিয় খাদ্যের হজম ক্রিয়ার এবং হজম পরবর্তী খাদ্যের যাবতিয় সার বস্তুর শোষন নিয়ন্ত্রন করে। এর স্বভাব বা পকৃতি হলো উষ্ণ, আদ্র এবং হালকা। ৩য় সার বস্তু “কফ/শ্লেষ্মা” , অনেক সময় পানি বা শ্লেষ্মাকে জীবনের মূল ভিত্তি বলা হয় , এটি আমাদের দেহের সকল গঠন ক্রিয়া নিয়ন্ত্রন করে। এটি আমাদের দেহের নিত্ত নতুন কোষ তৈরি , মাংশ পেশির গঠন, হাড়ের গঠন এবং বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রন করে। এর পকৃতি বা স্বভাব হলো ঠান্ডা, আদ্র এবং ভারী।
এই বায়ু পিত্ত এবং কফের সমন্নয়ে আমাদের দেহ গঠিত বলে, এ গুলোর যে কোনো একটির ভারসম্যহীনতা বা অস্বাভাবিকতা আমাদের দেহে বিভিন্ন প্রকারের রোগ সৃষ্টি করে ।
.
রক্ত দূষিত হওয়ার কারনঃ
মধ্যপান , মদ্যজাতিয় দ্রব্য সেবন, লবন, ক্ষার, অম্ল ও কটু দ্রব্য সেবন, কুলত্থ কলাই, মাষকালাই, শিম, তিল তৈল,পিন্ডালু , মূলা পভৃতি দ্রব্য, হরিৎ বর্ন দ্রব্য, জলজ মাংশ, আনুপ মাংশ , বিলেশয় মাংশ, প্রসহ মাংশ, দধি , কাঁজি, শুক্ত , সুরা, সৌবির, বিরুদ্ধ দ্রব্য, পচা দ্রব্য, পুতিগন্ধি দ্রব্য অতিমাত্রায় ভোজন করলে এবং দ্রব , স্নিগ্ধ ও গুরু দ্রব আহার করে দিবা নিদ্রা গেলে, অতিভোজন করলে , ক্রোধ করলে, সুর্যতাপ ও বায়ুর অতি সেবন করলে, বমির বেগ ধারন করলে, উপযুক্তকালে শোনিত মোক্ষণ / রক্তমোক্ষণ না করলে রক্ত দূষিত হয়ে থাকে ।
পরিশ্রম , আঘাত, অগ্নিসন্তাপ, অজীর্ন ভোজন ও অধ্যাশন দ্বারাও রক্ত দূষিত হয়ে থাকে । এবং শরৎকালে কাল স্বভাববসতঃ রক্ত দূষিত হয়ে থাকে ।
দূষিত রক্তজনিত রোগ , যার জন্য রক্তমোক্ষণ করতে হয়ঃ মুখ,নাক ও চক্ষুর পাক, নাকে ও মুখে দুর্গন্ধ, গুল্ম, উপকুশ, বিসর্প,রক্তপিত্ত, সততচিন্তা, বিদ্রধি, রক্তমেহ, প্রদর,বাতরক্ত, দেহের বিবর্নতা, অগ্নিমান্দ্য, পিপাসা, গাত্রগুরুতা, সন্তাপ, অতিদৌর্বল্য, অরুচি, মস্তকের অতি যন্ত্রণা, অন্নপানের বিদাহ, তিক্তোদগার, আম্লোদগার, ক্লান্তি, ক্রোধের আধিক্য, বুদ্ধিভ্রম, লবণাস্যতা, ঘর্মাগম,গাত্রদৌর্গন্ধ, মত্ততা,কম্প, স্বরভেদ, অতিতন্ত্রা, অতি নিদ্রা, অন্ধাকারদেখা , কণ্ডূ, ব্রন, কোঠ, পিড়কা, কুষ্ঠ ও চর্মদলাদি, চর্মরোগ সমূহ দূষিত রক্ত থেকে উৎপন্ন হয়।
সাধ্যভাবাপন্ন যে সকল রোগ শীত, উষ্ণ, স্নিগ্ধ ও রুক্ষ্ম ভেষজ দ্বারা সম্যক চিকিতসিত হলেও প্রশমিত হয় না, তারাও রক্তদুষ্টি জনিত রোগ ।
এই রক্তদোষজনিত রোগ নিরাময়ের জন্য, রক্তপিত্ত নাশক ত্রিয়া, বিরেচন, অনুবাসন ও রক্তমোক্ষণ করতে হয়। । তবে এই রোগ সমুহ রক্তাশ্রয়ী বলে প্রথমে রক্তমোক্ষণ করে পরে বিরেচনাদি করাই উত্তম । সর্বশেষে রক্তপিত্ত নাশক ক্রিয়া করতে হয়।
.
আজ এই পর্যন্ত , পরে আরো জানাবো । কি খুব কঠিন লাগছে পড়তে ? আজ আয়ুর্বেদ কনসেপ্টের রক্তমোক্ষণের হিডেন ট্রুথ উন্মোচন করলাম ।
.
হিজামার বিস্তারিত জানতে আমার লেখা হিজামা বইটি পড়তে পারেন ।
Leave a Reply